top of page

যাউলে ছিন্তাফু

Writer's picture: Ramit SenguptaRamit Sengupta

Updated: Mar 13, 2019

সাল ২০১৪, জানুয়ারি মাস।


Kanchenjungha from Chintafu Nepal
ছিন্তাফু থেকে কাঞ্চঞ্জঘা।

প্রথম পর্ব

কথায়ে বলে “মাঘের শীত, বাঘের গায়ে”, তা সে থাকুক ক্ষতি নেই। আমি আর আমার বন্ধু NRS মিলে ঠিক করলাম বরফ দেখতে স্বস্ত্রিক পাহাড়ে যাবো। পাহার মানে উত্তরবঙ্গের কোথাও। ভ্রমনের বেপারে আমার তখন অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে, কিন্তু একঘেয়ে বাঙ্কের চাকরি থেকে মুক্তির খুবই প্রয়োজন।

NRS মানে নীল রতন সামন্ত, আমার কলেজের বন্ধু, কদিন আগেই মটরসাইকেল দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছে। ডানপা- টা শরীরের সাথে এখনও লেগে থাকলেও, কাজ বিশেষ করে না। কিন্তু উত্তরবঙ্গ তার পরিচিত জায়গা, তাই ওর সাথে জোট বাধা। বুঝিয়ে বললাম-

“ভাই এমন ভাবে বেবস্থা কর যাতে আরামে গাড়ী করে ঘুরতে পারি। তোরও সুবিধাই হবে। খোঁড়া পা নিয়ে আর কতই বা হাঁটতে পারবি।”

সে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল, আমি মুর্খের মতো আস্বস্থ হলাম।

বেড়াতে যাওয়ার দিন যত এগিয়ে আসলো, কৌতূহল আরো বারতে থাকলো। সে নাকি তার কোন বন্ধু কাম গাইড অর্জুনের সাথে কথা বলে রেখেছে, কোনো চাপ নেই। কিন্তু বেরাতে কোথায়ে যাবো তা সে নিজেও জানে না, কত খরচা তাও কিছু বলে না, কিন্তু বরফ দেখার ফুল গ্যারান্টি।

এই করতে করতে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠে পরলাম। NRS কে এনকাউন্টার করে যতটুকু জানলাম, তাতে বুঝলাম, অর্জুন আমাদেরকে তার গ্রাম মানেভঞন অবধি যেতে বলেছে, সেখান থেকে আমাদের ট্যুর শুরু। ট্রেন বর্ধমান ছাড়িয়ে গেলেও আমরা শুধু জানলাম “গাড়ী করে বরফ দেখতে যাচ্ছি, ব্যস"


দ্বিতীয় পর্ব

দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত ,পাহাড়ের কোলে নেপালের সীমান্তবর্তি এক অপূর্ব সুন্দর গ্রাম মানেভঞন, যেদিকে তাকাই দেখে মনে হয় যেন সবুজের বিপ্লব ঘটে গেছে।


"যেন সবুজের বিপ্লব ঘটে গেছে"


শিলিগুড়ি থেকে বেশ অনেকটা পথ, প্রায়ে ৮০ কিলোমিটার, বেলা ৩ টে নাগাদ সদলবলে সেখানে পৌছালাম। অর্জুন ওখানেই হাজির আমাদের স্বাগত জানাবে বলে। আগের থেকে ঠিক করে রাখা চমৎকার একটা হোম-স্টে তে আমাদের রাত্রিবাসের বেবস্থা হোলো।



ধোয়া ওঠা দার্জিলিং টি আর কিছু পকোড়া দিয়ে তখনকার মতো জলখাবার সারলাম।

পাহাড়ের কোলে সূর্য তখন ডুবু ডুবু, আর দেরি নয়, চট করে চারজন বেড়িয়ে পড়লাম জায়গাটা দেখতে। পাহাড়ের গা দিয়ে, বাঁধানো পথ, সেটা ধরে নিচে নেমে ডানদিকে তাকাতেই চক্ষু-চরকগাছ, মস্ত সাইনবোর্ডে কাঁচা হাতে আঁকা এক নেপালি মহিলা হাতজোড় করে বলছে “Welcome to Nepal”। এই মরেছে আমরা এখন আছি কোথায়ে তাহলে? NRS যে বলেছিল উত্তরবঙ্গ, এতো দেখছি অন্য দেশে এনে ফেললো। মরুক গে যাক, জায়গা ভালো, থাকা খাওয়ার বেবস্থাও চমৎকার, কোথায়ে আছি না হয় পরে জানবো, আগে বেড়িয়ে তো নিই।


Manebhanjyag
মস্ত সাইনবোর্ডে কাঁচা হাতে আঁকা এক নেপালি মহিলা হাতজোড় করে বলছে “Welcome to Nepal”

ধালু রাস্তার দু পাশে ছোট ছোট দোকান, কোনোটাতে সব্জি সাজানো, কোনোটায় ফল, তারই মাঝখান দিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম। কিছুদূর পর দোকান গুলি শেষ হয়ে গেলো, চোখে পড়লো নেপাল পুলিশের চৌকি। ততক্ষণে সূর্য দুবে গেছে, দোকানগুলো পিছনে ফেলে এসেছি, রাস্তা সেভাবে নেই বললেই চলে তাই আলোর তো প্রশ্নই ওঠে না।

সোজা ‘U-Turn’। সুর সুর করে রাত্রিবাসের জায়গায়ে ফেরত আসলাম।


Manebhanjyang
নেপাল পুলিশের চৌকি

হোমস্টেতে ফিরে আরেক প্রস্থ ধোয়া ওঠা চা, তার সাথে চিকেন পকোড়া জমে উঠলো চার ইয়ারের আড্ডা।


NRS পরেছে মহা ঝামেলায়ে, সে অফিসে না জানিয়ে এসেছে, এখন মোবাইল-এ ফোন করলে যদি নেপালি ভাষায়ে কথা বলে তাহলে মহা বিপত্তি। মস্ত ঘরটার এধার ওধার করতে লাগলো, কোনদিকে ভারতের টাওয়ার পাওয়া যায়। মানে স্বদেশে ধুকে তবে সুইচ অফ করবে আরকি।

এদিকে সন্ধা সাতটা বাজতে চললো অর্জুনের কোনো পাত্তা নেই। অন্ধকারে এই কনকনে ঠাণ্ডায় কোথায়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে তার ঠিক নেই। আমি এদিকে ভাবছি আমাদের ট্যুরটার কি হবে। “গাড়ী করে বরফ দেখতে যাচ্ছি, ব্যস" এখনো এটাই জানি।


ঠিক যখন সাড়ে সাতটা বাজে, বাবু তখন গান গাইতে গাইতে ঢুকলেন। "হেই নীল, ক্যায়সা হায়, সুস্মিতা বাহেন কেমুন আছো?", নিশ্চিন্ত হলাম। যাক এবার তাহলে জানা যাবে আমাদের পরের গন্তব্য কি হতে চলেছে।


সুস্মিতা মানে NRS এর স্ত্রি। অর্জুনের সাথে ওরা আগেও বেরিয়েছে, তাই অর্জুন ভাইয়া বলতে সুস্মিতা একেবারে অজ্ঞান। ভাইয়াও বেস্ত হয়ে পরলো বোন রাতে কি খাবে সেই নিয়ে। সেই আলোচনা ধোঁয়ার কুন্ডলি পাকিয়ে উঠে, পৃথিবীর সমস্থ রান্নার নাম উচ্চারন করে, স্বাভাবিক ভাবেই মুরগির মাংস, আলু ভাজা আর রুটিতে এসে শেষ হোল। পাহাড়ের উপরে এর থেকে ভালো, আর কিছু হয় বলে আমার জানা নেই।


এই বাড়ির বাসিন্দারা নেপালি, সে অবধি ঠিক ছিল, মুস্কিল হোলো নেপালি ছাড়া আর কোনও ভাষা তারা জানে না। তাই অন্ধের জষ্ঠি অর্জুন, সে নীচে গিয়ে বলে আসলো আমারা কি খাব। এরপর শুরু হোল NRS আর অর্জুনের জুগলবন্দিতে গানের আসর। কেউ কারু চেয়ে কম নয়। পরে NRS এর কাছ থেকে জেনেছিলাম এই গান দিয়েই ওদের আলাপ, সান্দাকফু ট্র্যেকিঙ্গের সময়। NRS কে ও নিখরচায়ে ঘুড়িয়েছিল কারণ NRS কোনও প্লান ছাড়া বেরিয়েছিল তাই ওর কাছে টাকা ছিল না এবং NRS এর গান শুনবে বলে। অর্জুনের একটা গুন হোলো, দেশি বিদেশি নানা পর্যটক নিয়ে গাইড হিসেবে ঘোড়ে, তবে ট্যুর এর শেষে নিজের হাতে আর কিছু টাকা থাকে না। তার পর গ্রামে ফিরে বউএর কাছে রামধোলাই। একবার নাকি বউ গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো, সোজা হাঁসপাতালে ভরতি। যখন ছাড়া পেলো দুটো হাত আলাদা মাপের হয়ে গেছে। মাটির সাথে সমান্তরাল ধরলে বোঝা যায়ে। সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য।


নীচে কাঠের উনুনে রান্না হচ্ছে, সেই ধোয়া সারা বাড়ি ছড়িয়ে পরছে, তার গন্ধে পেটের ছুঁচো গুলি হঠাত কেত্তন গাওয়া আরম্ভ করেছে।


গানের মাঝেই বাড়ির মালিক এসে বলে গেলো খাবার তৈরি। "কোনও কথা না বারিয়ে, চুপি চুপি পা বারিয়ে" আমি আর ঝিনুক (আমার স্ত্রি) সোজা নীচে। বাকিরাও কিচ্ছুখনের মোদ্ধে হাজির।


উনুনে তৈরি কিছুটা মোটা, অথচ নরম রুটি তার সাথে নেপালি মশলায়ে তৈরি মুরগির ঝোল আর আলু ভাজা। পরম তৃপ্তির সাথে চেটে পুটে খেলাম। তারপর চললো জুগলবন্দি পার্ট ২।


"Haai neele gagan ke tale.... dharti ka pyar pale". Arjun Sherpa



নেপালের সেই ছোট্টো গ্রামে তখন নিঝুম রাত। গানের আওয়াজ ছড়িয়ে পরছে সারা পাড়াতে, আর আমি মন্ত্র মুগ্ধের মতো সেটা ক্যামেরা বন্দি করছি।

তৃতীয়ও পর্ব


“গাড়ী করে বরফ দেখতে যাচ্ছি, ব্যস", এখনো এটাই জানি।

পাহাড়ের নরম মিঠে রোদ্দুর মাখানো সকাল। ওখানকার মানুষদের কাছে, এ আবার নতুন কি? কিন্তু আমাদের কাছে যেন প্রান ফিরে পাওয়া।

সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিলাম। একটা সুমো এলো আমাদের নিতে। সেটা নাকি আমাদের কিছু আগডুম বাগডুম জায়গা ঘুড়িয়ে পশুপতি বাজারে ছেড়ে দেবে। সেখানে থেকে আমরা সরকারি ভাবে নেপালের সীমান্তে ঢুকবো।


মানেভঞন পশ্চিমবাংলায় এমন অদ্ভুত ভাবে অবস্থিত যে রাস্তার এদিকে নেপাল ওদিকে ভারত। কিন্তু সেখান থেকে নেপাল যাবার গাড়ির রাস্তা পশুপতি বাজারের মদ্ধ্যে দিয়ে।

নেপাল সীমান্তে গাড়ি বদল হোল, ঘন্টা দুয়েক বাদে আমরা পৌছালাম ইলাম বাজারে। সব লোক নেবে গেলেও আমরা ঠ্যেঁটা হয়ে বসে থাকলাম। কারন আরেকটু যেতে হবে বাজার ছাড়িয়ে।

এবার গাড়িটা একটা ছোট পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমরা নামলাম।

কিন্তু বরফ, বরফ কৈ?

আচ্ছা বরফ পাহাড়ের মাথায়ে।

ঠিক আছে। কিন্তু পৌছাবো কি করে। আমি তো জানতাম “গাড়ী করে..."

ওমা ভাবতে না ভাবতেই একটা টিনের বাক্সের মতো জিনিস হেলতে দুলতে সামনে এসে দাঁড়ালো।

এ-এ-এ মা এটা কি? ল্যান্ড রোভার, ফোর হুইল দ্রাইভ। একেবারে মিউজিয়াম ফেরত।

ভগবান... এটা করে যাবো। এটা পৌঁছাবে? মানে পারবে পৌছাতে?

ল্যান্ড রোভার, ফোর হুইল দ্রাইভ। একেবারে মিউজিয়াম ফেরত

ওদিকে অর্জুন তারা দিচ্ছে। সময় মতো রওনা না হলে নাকি দেরি হয়ে যাবে।

কি আর করবো দুগ্গা দুগ্গা বলে চেপে বোসলাম।

পাহাড়ের উপরেই দুপাশে ফশলের খেত, মাঝখানে আঁকাবাঁকা রাস্তা, তার ভিতর দিয়েই এগিয়ে চলেছি। কিছুক্ষণ পর চলা বন্ধ হোল, শুরু হোলো নাঁচা। মুড়ি বা মশলার কৌটো যেভাবে ঝাঁকিয়ে তাতে আরও মুড়ি আঁটানো হয় আমরাও সেভাবে সেট হয়ে গেছি। আবেগ আর চেপে রাখতে না পেরে অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই রাস্তার নাম কি। ও বললো এই সব গ্রামের রাস্তার কোনও নাম নেই। প্রত্যুতরে আমি বললাম, তাহলে আজ থেকে এর নাম হোক "Michael Jakson Road"। গারিতে একটা হালকা হাসির রেশ উঠলো বটে কিন্তু ঝাকুনিতে তা বেশিক্ষণ স্থায়ি হোল না।

আমরাও সেভাবে সেট হয়ে গেছি।


বেশ কিছুক্ষন চলার পর গাড়ী এসে দাঁড়ালো মাইপোখরি গ্রামে। চায়ের বিরাম, নাঁচারও। জানলাম এখানে একটা খুব সুন্দর পবিত্র লেক আছে যা আমরা ফেরার সময়ে দেখবো।


Maipokhri Lake Nepal
মাইপোখরি লেক

শরীরের নাট বোল্টুগুলো টাইট দিয়ে আবার চড়ে বসলাম। যাত্রী তালিকায়ে একজন নেপালি যুবতি তার সন্তান সমেত যোগ হোল। তিনিও ওপরে কোন গ্রামে যাবেন। এগুতে শুরু করলো আমাদের টিনের বাক্স।

Nepali women with her child at Maipokhri Nepal
একজন নেপালি যুবতি তার সন্তান সমেত যোগ হোল

কোনো গাড়িকে কখনও হামাগুড়ী দিতে দেখেছেন? বা তার চাকাগুলিকে আলাদা আলাদা করে পা ফেলতে?

আমরা দেখেছি।

রাস্তা, ঝর্না, পাহাড়, জঙ্গল সব মিলে মিশে একাকার। তার মধ্যেই আমাদের ফোর হুইল ড্রাইভ ল্যান্ডরোভার আলতো আলতো করে পা টিপে টিপে চলেছে।

এমন সব "Hair-pin" বেন্ড যে একবারে বাঁদিক বা ডানদিক ঘুরবেন তার কোন উপায়ে নেই। পা দুটো আকাশের দিকে তুলে সোজা এগিয়ে যান, আবার ব্যাক গিয়ারে ডান দিক চেঁপে পিছনে আশুন, তাতে জিপের একটা চাঁকা যদি পাহাড়ের কোনায়ে ঝোলে, কুছ পরয়া নাহি। এবার সাবাই মিলে দেহের ভর বাঁদিকে করে দিন, তবে গিয়ে ড্রাইভার বাঁদিকের রাস্তায়ে তিরিং করে লাফ দিয়ে উঠতে পারবে।

নেপালের রাস্তা

একবার তো গাড়িটা ব্যাক করতে গিয়ে সোজা খাদেই ঢুকে যাচ্ছিল। সুস্মিতা "ও... মা... গো..." করে ওঠায়ে তাও থামল। না হলে এই লেখা মনে হয় হয়ে উঠত না। গাড়ির তখন এক ঠ্যাঙ ঝুলছে সেই অবস্থায়ে ড্রাইভার বদল হোলো। জানলাম যে এতক্ষন চালাচ্ছিল তার হাতেখড়ি হচ্ছে। সবাই মিলে অনুরোধ করলাম যাতে হাতেখড়ি স্বরস্বতি পূজোর দিনক্ষন মেনে হয়। তার এখনও বেশ কিছুদিন সময় আছে।

আত্মারামকে কোনোমতে খাঁচায়ে পুরে, গুটি গুটি পায়ে আমরা এসে পৌছা্লাম পুর্ব নেপালের পাহাড়ে ঘেরা আরেকটা গ্রাম মাইমাজুয়া। আজ আমাদের এখানেই রাত্রিবাস। এটা নাকি অর্জুনের অনেকগুলো শ্বশুরবাড়ির মধ্যে একটা।

বাড়ির বাসিন্দারা যথারীতি হিন্দি বোঝে না। যা বলি তাতেই হাসে।

হ্যাঁ দুটো নেপালি শব্দ আমরাও শিখে ফেলেছি তা হোলো "তাতে পানি" অর্থাৎ গরম জল।

সেই তাতে পানি দিয়ে হাতমুখ ধুলাম। সব কিছু উনুনেই গরম হয়, তাই জলেও ধোয়া মেশানো গন্ধ্য।

সুন্দর পরিপাটি বিছানা, দুটো মনে হয় বেশিই ছিল। তার উপরেই সব জিনিশপত্র স্তুপাকার করে রাখলাম। রাতে কুঁকরা (দেশি মুরগি) আর রুটি দিয়ে খাওয়া সেরে সুরুত করে ধুকে গেলাম কম্বলের তলায়ে। ব্যস আর কিছু মনে নেই।


চতুর্থ পর্ব


খুব ভোরে ঘুম ভাঙল কুঁকরার ডাকেই। প্রথমে স্বপ্ন ভেবেছিলাম। কাল রাতে বেটাকে খেয়েছি তাই ভয় দেখাচ্ছে।

কিন্তু না বার বার "কোঁকর কু, কোঁকর কু" ঘড়িটা হাতে নিয়ে দেখি সাড়ে তিনটে বাজে। কিন্তু ওরা তো ৪ টের থেকে ডাকে বলে মনি বলতো। মনি মানে আমার দিদা। এইসব হাঁস মুরগির গল্প শুনিয়ে যে আমাকে বড় করেছে।

তাহলে কি নেপালের সময় আমাদের থেকে ১৫ মিনিট এগিয়ে বলে হিসেবে গন্ডগোল হচ্ছে?

এই সব ছাতা মাথা ভাবতে ভাবতে আবার একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি, ঘুম ভাঙল অর্জুনের আওয়াজে। "এই নীল আর কত ঘুমাবি ?" বেটা ঠিক ছটার সময়ে উঠে পড়েছে। বাবুর নাকি স্নানও হয়ে গেছে।

আমরাও আর দেরি না করে তৈরি হয়ে নিলাম। গ্রাম দেখতে বেরবো, তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে আবার নাঁচতে যেতে হবে।



পরিপাটি করে সাজানো গ্রাম, অধিকাংশ বাড়ির সামনেই অর্গানিক ফসলের রঙিন বাহার। কোথাও আবার মহিলারা ভেরার লোম জড় করে চরকায় উল বুনতে বসেছে। কাছেই একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আজ জানিনা কেন সেটা বন্ধ। চলতে চলতে বেশ কিছুটা সমতল জায়গায় এসে পড়লাম। এটা এখানকার চাষের ক্ষেত। স্ত্রী পুরুষ মিলেমিশে হাসি মুখে চাষ করছে। চাষের ফাঁকে ফাঁকেই চলছে ঠাট্টা ইয়ার্কি। এরা বাইরের মানুষ খুব বেশি দেখে না, তাই আমাদের দেখে খুশীর সীমা নেই। অনুরোধ করতেই খুশি মনে বসে পড়লো ক্যামেরায় ধরা দিতে।




ভালই কাটল সকালটা, এবার এগিয়ে যাবার পালা। অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলাম এবার কোথায় যাবো।

মুচকি হেসে সে বলল "গরু-ছাগল"।

মানে? কি হোল কেসটা? বিরক্ত হয়ে গালাগাল করছে নাকি?



দুপুরের খাবার খেয়ে, তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। অর্জুন বললো সামনের পথ নাকি আরও দুর্গম।

তা এবারে আর পথ বলতে কিছু নেই, যা আছে তা দিয়ে বড়জোর একজন মানুষ কোনোমতে হেঁটে যেতে পারে। তাও মাঝখানে মাঝখানে বড় বড় পাথর পথ আগলে রেখেছে। মানে হেঁটে গেলেও হাতে ভর দিয়ে পাথর টপকে তবে যেতে হবে।


Nepal Roads
সেই দুর্গম পথ

এরকমই একটা মস্ত পাথরের সামনে এসে গাড়িটা দাড়ালো, আমরা ভাবলাম এবার বুঝি নেমে যেতে হবে। কিন্তু না। পাথরটার সামনে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ গ-অ-অ-অ! গ-অ-অ-অ! আওয়াজ করলো তারপর ব্যাক গিয়ারে এসে... একি... একি... ডানদিকে পাহাড়টার গা বেয়ে উঠে গেলো মাইরি! তারপর এক ঝটকায়ে বামদিক ঘুরে পাথরটা কাটিয়ে নেমে গেলো... দুগ্গা!!! তলায় একটা ঘটাং করে আওয়াজ হোলো ঠিকই, কিন্তু ড্রাইভার নির্বিকার। সে আবার নিজের মতো চলতে লাগলো।


এবার আর ভালো লাগছে না। সহ্যের একটা সীমা আছে। বরফের তো নাম গন্ধ নেই, গাড়ী আর রাস্তার তথৈবচ অবস্থা। অনেক পরিশ্রম করে একটা তিলোত্তমা ভুরি বানিয়েছি, তা নিয়ে এত হাঁপা হাঁপি আমার মোটে ভালো লাগছে না। তার মধ্যে জায়গার নাম জানতে চাইলে বলছে "গরু-ছাগল"।


আমি তো ভেবেছিলাম “গাড়ী করে বরফ দেখতে যাচ্ছি, ব্যস"।


অর্জুনকে যে কিছু বলব সে সাহস হোল না, এখানে যদি নামিয়ে দেয় তাহলে বাকি জীবনটা রাস্তা চিনে নিচে নামতে কেটে যাবে।


তবে আশার আলো বলতে সুস্মিতা দেখছি আস্তে আস্তে আমার দলে ভিড়ছে। মানে ওকে যদি টেনে নেওয়া যায়, তাহলে অর্জুন কাবু। বাহেনের জন্য সে ফেরত যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে।

এইসব আগডুম বাগডুম ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছি, হঠাৎ ঘটাং ঘটাং করে শব্দ, গাড়ির বনেট থেকে কালো ধোঁয়া বেরুতে শুরু করলো, দু তিনটে ঝাকুনি, ব্যস!! উনি দেহ রাখলেন। আমরা আর কি করবো কিছুক্ষন অপেক্ষা করে নেমে পড়লাম। এদিকে সন্ধ্যে প্রায় নামো নামো, কনকনে ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে। ড্রাইভার সাহেব অনেক চেষ্টা করলেন ওতে প্রাণ সঞ্চার করতে কিন্তু "যে যায় সে কি আর ফেরে রে পাগলা"।


Garuwale Bhanjyang
ড্রাইভার সাহেব অনেক চেষ্টা করলেন ওতে প্রাণ সঞ্চার করতে

একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। দুজন মহিলা নিয়ে এই হিমালয়ের চূড়ায় এবার কি হবে? তাও আবার অন্য দেশে। সম্বিত ফিরল অর্জুনের ডাকে। যে গ্রামে আমাদের আজ রাত্রিবাসের কথা,বরাত জোরে সেটা নাকি সামনেই। এক কিলোমিটারও নয়। তাই হেঁটেই যাওয়া যাবে। সেখানে পৌঁছে ,বলে দিলেই জিনিসপত্র সব মাথায় করে এসে নিয়ে যাবে।

এরপর আর ভাবার কোনো অবকাশ নেই। শুরু হলো আমাদের মিনি ট্রেকিং।

অর্জুনের এটা পরিচিত জায়গা স্বাভাবিক ভাবেই নেতৃত্ব ভার ওর উপরেই বর্তালো।

সবার আগে আমিই অর্জুনের পিছু নিলাম, তারপর একে একে সুস্মিতা ও ঝিনুক। সবার শেষে NRS। খোঁড়া পা নিয়ে, ছবি তুলতে তুলতে দুই বৌকে "Guard of hounour" দিয়ে নিয়ে চলল।


Garuwale Bhanjyang
খোঁড়া পা নিয়ে, ছবি তুলতে তুলতে দুই বৌকে "Guard of hounour" দিয়ে নিয়ে চলল

পথের দুধারে সারি সারি গুরাস গাছ। এখন কোন ফুল নেই, কিন্তু এপ্রিল মে মাসে প্রতিটি পাহাড় আলাদা আলাদা করে রাঙ্গিয়ে তোলে। আমি তো ছাই গাছ চিনি, পথে অর্জুন সব দেখাতে দেখাতে নিয়ে চললো। আরও জানলাম এখানে নেকড়ে, ভাল্লুক, হরিণ আরও প্রায় খান তিরিশেক জংলী প্রাণীর বাস। তবে অন্য কোন প্রাণী নয় আমার চিন্তা অর্জুনকে নিয়ে। এরপর যে ও কি খেল দেখাবে তা ভগবানই জানে।


প্রায় আধা ঘণ্টা প্রাণ পাত করে হাঁটার পর, কটা ঘর বাড়ি চোখে পড়লো, এই নাকি সামনে!


হাতে গোনা পাঁচটা বাড়ি নিয়ে গ্রাম, সেগুলতে সভ্যতার ছোঁয়া সবে লেগেছে। নীচে থাকে গৃহপালিত পশু, উপরে মানুষ। এরই মধ্যে একটাতে আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে যাবো দেখি কাঠের ওপর লেখা আছে "Welcome to you From Goruwala Bhanjyang"।


এতক্ষণ বাদে আমার মাথায় ঢুকলো গরু-ছাগল বলতে অর্জুন কি বোঝাতে চেয়েছিল।নিজের নির্বুদ্ধিতায় হাসতেও পারলাম না ঠিকমত। তবে আমিই বা কি করে বুঝবো যে গরুর নাম দিয়েও একটা জায়গার নাম হতে পারে। মাইমাজুয়া বা গারুওয়ালে দুই জায়গার আস্তানাই অর্জুনের ঠিক করা, ওর পরিকল্পনা ছিল যে এই সব জায়গায় ও উন্নতমানের হোম-স্টে বানাবে এবং দেশি- বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে আসবে। তার থেকে কিছু রোজগার এলে এখানকার গরীব সরল মানুষগুলির কিছুটা হলেও সুরাহা হবে। আপাতত এদের জীবন চাষবাস, পশু-পালন ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির সাথে লড়াই করেই কেটে যাচ্ছে।

মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক, যাই হোক আমাদের জন্যে নির্দিষ্ট করা ঘরে প্রবেশ করলাম। সম্পূর্ণ কাঠের বাড়ি, পাটাতন এর মধ্যে মধ্যে প্রায় এক আঙ্গুল ফাঁক, তা দিয়ে প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া প্রবেশ করছে। নিচের প্রবেশদ্বার পাহাড়ের নীচে, উপরের প্রবেশদ্বার ঠিক উল্টো দিকে পাহাড়ের উপর। তাই সিঁড়ির কোন প্রয়োজন নেই, উপরে উঠতে গেলে পাহাড় বেয়ে ওঠো। এটাই আমাদের হোমস্টে, আজ রাত এখানে কাটাতে হবে।


Garuwale Bhanjyang
আমাদের হোমস্টের সামনে অর্জুন এবং গ্রামের অন্যরা

ব্যাগপত্র রেখে দিলাম ঘরের ভিতর, তারপর বাইরে বেরিয়ে জলের খোঁজ করতে লাগলাম। গ্রামের একজনকে দেখতে পেয়ে হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা যা যা ভাষা জানি জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলাম, এখানে টয়লেট টা কোথায়?

টয়লেটের নাম শুনতেই ভুরু কুঁচকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে এমন ভাবে সে আমার দিকে তাকালো যেন ওর হৃদপিণ্ডটা চেয়ে বসেছি। আচ্ছা মুশকিল তো! ঐতো অর্জুন, দেখি ওকে জিজ্ঞেস করি যদি ও কিছু আলোকপাত করতে পারে। হ্যাঁ অর্জুন জানে টয়লেট কোথায় এবং সেটা সে দেখিয়ে দিল, তবে তার ফলে যেটা হলো সেটা আলোকপাত নয় - অনেকটা বজ্রপাত।

আমরা যে সমতল ভূমির উপর দাঁড়িয়ে আছি তার ঠিক পাশেই আরেকটা পাহাড়ের চূড়া , টয়লেটটি তার উপরে। কিন্তু অত উপরে লোকালয়ের বাইরে টয়লেট থাকার কারণ কি?

অনেকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকার পর বুঝলাম ওই পাহাড়ে একটা ঝর্ণা আছে, যার জল একটা নালার মধ্যে দিয়ে নিচে নেমে আসছে। টয়লেটটা এমন ভাবে নালাটার উপর বানানো যাতে মানুষের পয়ঃপ্রণালী ওই নালার জল দিয়ে নিজের থেকেই ধুয়ে যায়। কত সহজ অথচ কার্যকরী পদ্ধতি।

এখন তো শুধু হাত মুখ ধোয়া, অত উঁচুতে উঠে কাজ নাই। তাই "তাঁতে পানি" দিয়ে ওখানেই হাত মুখ ধুয়ে নিলাম, ততক্ষণে আমাদের জিনিসপত্র সব মাথায় করে এসে গেছে। সে সব একে একে ঘরে গুছিয়ে জায়গাটা এক চক্কর মারতে বেরোলাম।



গ্রামের কেন্দ্র থেকে যেদিকেই হেঁটে যাও পাঁচ মিনিট, ব্যস গ্রাম শেষ। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, তার মধ্যে কুয়াশায় ভরা ঘন জঙ্গল। এমনিতেই দেরি করে পৌঁছেছি, বেলা প্রায় যায় যায়, তাই বেশিদুর কোথাও যাওয়া গেলো না। ফিরে আসলাম আমাদের মাচার উপরে।




ততক্ষণে NRS আর অর্জুন মিলে যুগলবন্দী শুরু করে দিয়েছে। আমি আসাতে আরও উৎসাহ পেয়ে মোবাইলের হিন্দি গান শুরু হলো। এই স্থুলকায় শরীর নিয়ে কাঠের পাটাতনের উপর নাচ। ঘাবড়ে গিয়ে ঝিনুক চিৎকার করে উঠলো, "রমিত, ঘরটা এবার ভেঙ্গে পরে যাবে"। বৌয়ের সতর্কবার্তা কানে যেতেই সুর সুর করে এসে খাটে বসে ভিডিও রেকর্ডিং এ মন দিলাম।



পাহাড়ে বাঙ্গালীদের সেরা খাবার রুটি আর মুরগির মাংস হলে, নেপালীদের সেরা খাবার কি? থুপকা!



আজ সবাই থুপকা দিয়েই রাতের খাওয়া সারব, তাই নীচের রান্নাঘরে উপস্থিত হলাম। নেপালে আসার পর থেকে কাঠ ছাড়া অন্য কিছুতে আগুন জ্বালাতে দেখিনি। এখানেও তার কোন ব্যতিক্রম নেই। নতুন যেটা চোখে পড়লো তাহোল মোষের মাংস টুকরো টুকরো করে কেটে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা আছে। যখন ইচ্ছে তখন রান্না করে খাও। তাপমাত্রা সারাক্ষন শূন্যের কাছেই ঘোরা ফেরা করছে, তাই পচন ধরার কোন চিন্তা নেই।



খাওয়া দাওয়া মিটিয়ে চলে আসলাম উপরে। উফ কি ঠাণ্ডা! যেন এভারেস্টের মাথায় ছেড়ে দিয়ে গেছে। আগেই বলেছি কাঠের ঘর, আর কাঠের মাঝে মাঝে এক আঙ্গুল ফাঁক, হু হু করে বাতাস ধুঁকছে। সঙ্গে আনা হুইস্কির ৬ পেগ মেরেও নিস্তার নেই, একই বিছানায় যে যার বৌ বগলদাবা করে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছি। অর্জুন ঘরের মেঝেতে গুড নাইট বলে শুয়ে পড়লো, কিন্তু আমরা, আমরা কি করবো? লেপ , কম্বল, জ্যাকেট, মোজা গ্লাভস্ সব অকেজো। টান টান হয়ে শুয়ে আছি, কোনোদিকে ফেরার উপায় নেই, ফিরলেই অন্যদিকটা বরফের মতো ছ্যাঁক করে কামড়াচ্ছে। NRS কিছুক্ষন গান গেয়ে মনোরঞ্জন করলো। আস্তে আস্তে সেই গান গোঙানিতে পরিবর্তন হোলো, তারপর সব চুপ।


পঞ্চম পর্ব

কতোক্ষণ ওই ভাবে কেটেছে তার খেয়াল নেই। এতোক্ষণ ধরে খুব জোর বাথরুম পেয়েছে, এবার না গেলেই নয়। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত ২ টো। কিছুক্ষণ আগেই বাইরে খস্ খস্ আওয়াজ পেয়েছি। সেই তিরিশটার মধ্যে কোন পশুটা ঘুরছে কে জানে? সঙ্গে আনা টর্চটা হাতে নিতে উঠে দাঁড়ালাম। আর পারছিনা, যা হয় হবে। কোনমতে টিনের দরজাটা খুলতেই ঘটাং করে একটা আওয়াজ হলো। NRS সাড়া দিলো , "কোথায় যাচ্ছিস, সাবধানে, আচ্ছা তুই ঘুরে আয় তারপর আমি যাবো"।

মনে কিছুটা বল পেলাম।

ঘর থেকে তিন চার হাত দূরে নিজেকে হালকা করছি, শরীরের "তাঁতে পানি" পাহাড়ি ঝোরার মতো কোথা কোথা দিয়ে এঁকে বেঁকে আসছে স্পষ্ট বুঝতে পারছি। বুঝব নাই বা কেন, বাকি শরীর তো পাথরের মতন ঠাণ্ডা। নিজেকে গুঁটিয়ে এবার ঘরে ঢুকতে পারলে হয়। চারদিক নিস্তব্ধ, কোন প্রাণের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ফিরছি, হঠাৎ মনে হোলো এত আলো আসছে কোথা থেকে? চাঁদ তো নেই আকাশে, তাহলে...

ওপরের দিকে তাকাতেই মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো। হিরে, মানিক, জহরত সব যেন আঁঠা দিয়ে কেউ লাগিয়ে দিয়ে গেছে ওই ছায়াপথে, যে কোন মুহূর্তে খসে পরলে দাবানল লেগে যাবে। হাঁ করে তাকিয়ে আছি অনেকক্ষণ, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছেনা, বিশ্বাস হচ্ছে না যা দেখছি।

কোনোমতে NRS কে ডাকলাম, একে একে সুস্মিতা ও ঝিনুক। আমরা চারটি বিন্দু, হিমালয়ের চূড়ায় ব্রহ্মান্ডের এক অলৌকিক রূপ দর্শন করছি। এতদিনের কষ্ট, অভিযোগ, সব যেন সে শুষে নিয়েছে মুহূর্তের মধ্যে, শরীর মন সব হালকা লাগছে। এতক্ষণ ঘরের ভিতর কম্বলের তলায় কাঁপছিলাম, এখন খোলা আকাশের নিচেও কোন কষ্ট হচ্ছে না।


বাকি রাত তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই কাটল, ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই অর্জুন উঠে পড়লো। রাত শেষ, যুদ্ধবিরতি সমাপ্ত, আবার তার নেতৃত্ব দেবার পালা।

আমরা সারা রাত জাগা, কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না, শুধু এটুকু বুঝছি যে আবার হাঁটা শুরু হয়েছে। এবার একেবারে পাহাড় চড়া। NRS একটা লাঠি হাতে সবাইকে তাড়িয়ে তারিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর "অর্জুন, সেতো অর্জুন" পথ দেখাচ্ছে। হায় রে অদৃষ্ট ! এই ছিল কপালে। এতদিন তো ভেবেছিলাম “গাড়ী করে বরফ দেখতে যাচ্ছি, ব্যস"।


Chintafu Nepal
NRS একটা লাঠি হাতে সবাইকে তাড়িয়ে তারিয়ে নিয়ে যাচ্ছে

অনেকটা পথ চলার পরে একটা উঁচু টিলার সামনে এসে দাঁড়ালাম, নিচ থেকেই বোঝা যাছে উপরটা একেবারে টেবিল এর মতো সমতল। আমরা দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছি আর পরিকল্পনা করছি কী ভাবে ওটাতে চড়বো, অর্জুন তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠে চলে গেলো, আমরা তখনও হুব্বার মতো দাঁড়িয়ে, দম নিচ্ছি। কাল রাতের হাঙ্গওভার এখনও কাটেনি। পাথরের খাঁজ গুলো মাপছি, কোনটাতে পা দিলে সুবিধা হয়। যা বুঝছি এবার আর শুধু পা দিয়ে হবে না, হাত লাগাতে হবে, মানে হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হবে।


Chintafu Nepal
পাথরের খাঁজ গুলো মাপছি

হঠাৎ দূর থেকে অর্জুনের গলার আওয়াজ পেলাম, "NRS দেখে যা, বরফ... বরফ... হি হি হি... হা হা হা..."


তার মানে, নীচে তো বরফের কোন চিহ্ন নেই, আর পাঁচ ফুট উঁচুতে কিনা...

এবার ঝিনুকের গলা, সে আমায় টপকে কখন উঠেছে জানিনা... শুধু রমিত রমিত করছে, উত্তেজনায় আর কোনকিছু উচ্চারণ করতে পারছে না, রমিত রমিত করেই চলেছে।


না, আর দাঁড়িয়ে কাজ নেই, হাত, পা, মাথা, বুক, যা যা সম্ভব কাজে লাগিয়ে টেবিল এর ওপরে উঠলাম।

বিস্ময়ের আরেক নাম হিমালয়... বামদিকের কোণে মাউন্ট মাকালু , তারপর এভারেস্ট, ডান দিকে মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা। এক এক করে মাউন্ট পান্ডিম , মাউন্ট কাব্রু, কাব্রু নর্থ, কাব্রু ডোম, মাউন্ট জানু, মাউন্ট থ্রি স্টার, রাথাং আরও কত সব নাম না জানা শৃঙ্গ।


১৮০ ডিগ্রির বিশাল ক্যানভাস জুড়ে, নীল আকাশের নীচে হিমালয়ের বাকরুদ্ধ করা উপস্থিতি


হিমালয়ের তুষার শৃঙ্গ সপরিবার আমাদের অপেক্ষায় এতোক্ষণ বসে ছিল। আমার পায়ের কাছটা সবুজ, আস্তে আস্তে চোখ যত এগুচ্ছে পাহাড়ের উচ্চতা বাড়ার ফলে গাছপালা নেই, তাই সেগুলো কালো। সেই ঢেউ খেলানো কালো পাহাড় এগুতে এগুতে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে সুবিশাল তুষার প্রাচীরের গায়ে। তারপর এক আশ্চর্য আলোর বিস্ফোরণ। ১৮০ ডিগ্রির বিশাল ক্যানভাস জুড়ে, নীল আকাশের নীচে হিমালয়ের বাকরুদ্ধ করা উপস্থিতি। দূষণ মুক্ত নেপালের আকাশের নীচে যেন স্ফটিকের মতন ঝলমল করছে।


ল্যাঙরা NRS এর কথা এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিলাম, সে কিভাবে উঠেছে জানি না। আমরা এগিয়ে আসলেও সুস্মিতা নিজের প্রাণের মানুষটিকে ফেলে আসে নি। ঠিক টেনে তুলেছে পাহাড়ের চূড়ায়।

এবারে সে একটা পা, আর লাঠির উপর ভর করে ব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে এগিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের শেষে। "NRS আর যাস না", ঝিনুক ডাক দিলো। "ও এ রকমই, কারোর কথা শোনে না" পাশ থেকে ভেসে এলো অভিমানী সুস্মিতার কন্ঠস্বর। এই থাম, বেশি লাফাস না, আবার ফিরতেও হবে, আমার বকুনিতে সে থামলেও, বলে কিনা- আরেকটু এগুনো যাবে না? তুই কি তেনজিং? ইয়ার্কি হচ্ছে?


ক্যামেরা মোবাইল যার কাছে যা আছে ছবি তোলা চলছে। কিন্তু এই স্মৃতির কি কোন ছবি হয়? অনুভব করা যায় মাত্র।


সেই আনন্দের মুহূর্তে আমরা সবাই


NRS বুদ্ধি করে একটা ভিডিও করেছিল, সেটা আপলোড করছি আমার ব্লগে, আমাদের সেই মুহূর্তের আনন্দ এতে ধরা পরেছে।


অর্জুনকে কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানানোর কোন ভাষা নেই আজ। মিতভাষী ঝিনুক, সে অবধি আনন্দে খিল খিল করে হেসে চলেছে, আর বারে বারে বলছে "Thank you Arjun Da, Thank you Arjun Da". বেঁচারা NRS এত হাঁঁপিয়েছে নিঃশ্বাস প্রায় যায় যায়, সেই অবস্থাতেই নিজের ক্যামেরায় অর্জুনের শেষ কিছু কথা (নিজের অজান্তে) ভিডিও করলো।


ভিডিওটায় ঝিনুক জিজ্ঞেস করছে, "এই জায়গাটার নাম কি?" অর্জুন বলল ...

"যাউলে ছিন্তাফু"!!

এই প্রথম জানলাম আমরা কোথায় এসেছি।



ইলামে আর এক রাত কাটিয়ে এবার আমাদের ফেরার পালা। নিজেদের অজান্তে অর্জুনকে চিরবিদায় জানিয়ে আবার সেই পশুপতি বাজার, মিরিক হয়ে নেমে আসলাম।


আজ এতবছর পরে বিজয়ওয়ারাতে বসে পুরনো কিছু ভ্রমণ পত্রিকার সংখ্যায় ছিন্তাফু নিয়ে লেখা চোখে পড়লো। রাস্তা, পাহাড়, গ্রাম, ল্যান্ডরোভার সব একই রকম আছে। নেই শুধু আমাদের অর্জুন ভাইয়া।

 

বিদায়

রমিত সেনগুপ্ত

--------------------

বিদায় বন্ধু, বিদায়-

তুই শান্তিতে থাক চিরনিদ্রায়

পাহাড়ের ওই ছায়ায়।


কাঞ্চনের ওই আলোর ছটা

বলবে কেবল তোর-ই কথা,

রাত্রি শেষে ছিন্তাফু-তে

ফুটবে যখন ভোর।


মাইমাজুয়া, মানেভঞ্জন,

নেই কোন আর মনোরঞ্জন।

তোর গানের কলি কানে ভাসে-

কাটল না তো ঘোর।


বিদায় বন্ধু, বিদায়-

তুই অনন্তে থাক ঘুমিয়ে

হিমালয়ের ওই কোণায়।


~~ সমাপ্ত~~

Comentários


1.jpg
About Me

Ordinary Banker who loves to click while traveling, just to preserve golden memories of the past.

Read More

Join My Mailing List
  • White Facebook Icon
Meet me on social platform
bottom of page