top of page

অচিন পুরীর গপ্প - তৃতীয় পর্ব

Writer's picture: Ramit SenguptaRamit Sengupta


তৃতীয় পর্ব

সবে ভাত ঘুমটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি, চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ঝিনুক বলল “বাবা বলছিল কাল সকালে একবার রঘুরাজপুর যাবে”। তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠলাম। এটা কোন জায়গা? আগে তো শুনিনি কখনো, কি আছে সেখানে? মূর্তি, নদী, প্রাসাদ, অরণ্য... নতুন কিছু?

তুমি রঘুরাজপুর শোননি?

আহা! বলছি তো শুনিনি। বলোইনা কি আছে সেখানে?

ওটা একটা প্রাচীন গ্রাম, পটচিত্র-শিল্পীদের বাস। এর বেশী জানি না।

সঙ্গে সঙ্গে গুগল বাবার শরণাপন্ন হলাম।

উরিব্বাস, এ তো মারাত্মক কাণ্ড। মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে এত গুরুত্বপূর্ণ জায়গার নামই শুনিনি কখনও। সাধে কি দাসবাবুকে চলমান বিশ্বকোষ বলি। তা কাল কেন আজকেই চলো, বিকালে কোন রাজকার্য আছে শুনি? এখানে থাকলেই স্বর্গদ্বারে গিয়ে কেনাকাটা করবে, সে আরেক ঝামেলা।

আমরা মোট সাতজন তাই দুটো অটো লাগবে, কিন্তু আমার তো বাইক আছে তাই একটাতেই হয়ে যাবে। আমি আর তুমি না হয় তাতেই গেলাম। খরচ যৎসামান্যই হবে।

বড়রা তৈরি হতে না হতেই বাচ্চাদুটোও দেখি উঠে পড়েছে। দুপুরে ওরা নিয়মিত রি-চার্জ হয়, তাতে বাড়ির লোকজনও কিছুটা সময় হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

অটোওয়ালার সাথে ৩০০ টাকায় রফা হল। নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা আর এক-দের ঘণ্টা প্রতীক্ষার।সবাই মিলে রওনা দিলাম পটচিত্র-শিল্পীদের গ্রাম রঘুরাজপুর।পথে যেতে যেতে চোখে পড়লো আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের জমজমাট প্রচার। চারিদিক শঙ্খ চিহ্ন আর পদ্মফুলে ভরে গেছে। মাইক লাগানো গাড়ি গোটা গ্রাম ঘুরে ঘুরে ওড়িয়া ভাষায় প্রচার করছে। এই একই কায়দায় নির্বাচনী প্রচার অন্ধ্রতেও খুবই জনপ্রিয়। সামান্যই পথ, আধা ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম।



গ্রামের শুরুতেই প্রভাকর বড়ালের বাড়ি। এতক্ষন যেন সে আমাদের অপেক্ষাতেই বসে ছিল। সবাই মিলে তার কুঠিরে গিয়েই বসলাম। চারদিকে সাজানো গোছানো শিল্পের সম্ভার, মধ্যিখানে কাজের জায়গা। গোটা ঘর জুড়েই গড়ে উঠেছে আস্ত একটা হস্তশিল্পের কারখানা। পরম আগ্রহে সে বলতে শুরু করল উড়িষ্যার পট-শিল্পের ইতিহাস। ২৮০০ বছর পুরাতন এই গ্রাম, প্রায় শতিনেক পরিবারের বাস, প্রতিটি বাড়িতেই সমানতালে চলছে হাতের কাজ। কোন ছবি পটে আঁকা, কোনোটা বা তাল পাতায় । সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে যা কিছু পাওয়া যায় শিল্পের সরঞ্জাম বলতে সেগুলোই। পট-চিত্রের সাদা রং আসে শঙ্খের গুঁড়ো থেকে, কালো রং দীপ জ্বালিয়ে বানানো হয়। লাল, হলুদ, নীল বাকি সব রঙ আসে বিভিন্ন রঙের পাথর থেকে যা কিনা সমুদ্রেরই অংশ। আঁকা শেষ হলে পটচিত্রের সর্বাঙ্গে পালিশ করা হয় গঁদের গাছের আঠা। এর ফলে ছবির জৌলুস তো বারেই আর রংটাও পাকাপাকি ভাবে সেঁটে যায়। সামান্য যত্ন নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করলে আজীবন হয়ে থাকতে পারে আপনার বৈঠকখানার সঙ্গী।




শিল্পী প্রভাকর বড়ালের তৈরি পট-চিত্র


পটের সৃষ্টি কাপড় থেকে, কাপড়ের তিনটি স্তর একত্রিত করে তৈরি হয় এক একটি পট বা ক্যানভাস, তার উপরই শিল্পীরা ফুটিয়ে তোলেন পৌরাণিক কাহিনী ও দেব দেবীদের চিত্রকলা। রামায়ন, মহাভারতের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ তো আছেই, তাছাড়া আছে জগন্নাথ দেবের কথা। যুগ যুগ ধরে এই চিত্রকলা ভারতের তথা হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এত কিছু কথা বলতে গিয়ে হয়তো নিজেদের কথাটাই আর বলা হয়ে ওঠেনা এখানকার মানুষদের। তবে উড়িষ্যার পর্যটন বিভাগের উদ্যোগে রঘুরাজপুর আপাতত হেরিটেজ ভিলেজ রুপে পরিচিত, তাদের সাইন বোর্ড চোখে পরল। সরকারি উদ্যোগে বেস কিছু আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ও মেলাতেও অংশগ্রহণ করছেন এখানকার মানুষ। তবে শিল্পীরা নিজেরা সাধারণত যান না, তাদের জিনিস নিয়ে যান তাদের প্রতিনিধিরা। এক একটি পূর্ণকায় পটচিত্র তৈরি হতেই সময় লাগে ১৫ দিন থেকে দুই মাস। শিল্পীদের কথায় সেই সময়টুকু তারা অন্য কোথাও ব্যায় করতে ইচ্ছুক নন। একটি পট-চিত্রে কেবলমাত্র একজন শিল্পী লাগাতার কাজ করেন।

চিত্রের সূত্রপাত তিনটি সরলরেখায় ভর করে, ক্রমশ তা বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। বরাতজোরে একটা ভিডিও তুলতে পারলাম, যেখানে চোখের নিমেষে সাদা কাগজ রূপান্তরিত হল এক আশ্চর্য্য চিত্রকলায়। ভিডিওটি দেওয়া থাকছে আমার ব্যক্তিগত ব্লগে, চাইলেই এসে দেখতে পারেন।


প্রভাকর বড়ালের ভিডিও

https://youtu.be/FHr073QadKA


ইতিহাস নাকি বলছে পুরীর রাজা মন্দির নির্মাণের পর স্বয়ং এই গ্রামের শিল্পীদের কাছে অনুরোধ করেন পটচিত্রে ঠাকুরের ছবি এঁকে দিতে। সেই শুরু, অনন্ত নারায়ন ওরফে জগন্নাথ, অনন্ত বাসুদেব ওরফে বলরাম এবং ফুলেশ্বরী অর্থাৎ সুভদ্রা এই তিন জনের ছবি দিয়ে মন্দিরে পুজোর সূত্রপাত।



রঘুরাজপুরের রত্নখচিত পরিমণ্ডল যারা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন তাদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য নাম - শ্রী কেলুচরন মহাপাত্র, যিনি কিনা ওড়িসি নৃত্যকলায় পারদর্শী এবং ডোনা গাঙ্গুলির গুরু; এছাড়া শিল্পী জগন্নাথ মহাপাত্র ও গোটিপুয়া নৃত্যশিল্পী শ্রী মাখনি দাস। তাদের কথাও ঘুরে ফিরে এলো প্রভাকর বড়ালের বয়ানে।

তাল পাতার ছবি আঁকার পদ্ধতি অন্য। লোহার কলমের আলতো আঁচড়ে দাগ কাটা হয় পাতার উপরে, তারপর কালি লাগিয়ে জল দিয়ে ধুয়ে ফেললেই ব্যস! ছিলো পাতা হল পাখি।



প্রাণভরে সেই সব দেখছি আর ভিডিয়ো করছি হঠাৎ ছেলেদের চিৎকার- “পাখি, পাখি- মা পাখি”।

বোঝ ঠেলা এদেরকে সঙ্গে নিয়ে কেবল একটা শিল্পই সম্ভব, তা হল যুদ্ধ শিল্প। হাতের নাগালে এতো কিছু রংচঙে জিনিস দেখে আর সামলানো যায়। একই রকম বিপদে পড়েছিলাম ভুরি সিং জাদুঘরে। হিমাচলের রাজার টুপি হাম্পির লাগবেই লাগবে, সটান শুয়ে পড়েছিল জাদুঘরের মেঝেতে।

যাইহোক দুখানা নারকেল ছোবড়ার “ঘোয়া” তাদের দাদু কিনে দেওয়ায় এ যাত্রায় মুক্তি পেলাম।



সঙ্গে তিন নম্বর শিশুটি হলেন আমার জননী। বিষ্ণুর দশ অবতারের দুজন তো বাড়িতেই আছে, তাতে হবে না পুরোটাই লাগবে। এক একটা ছবি পাঁচ ছয় হাজার টাকা দাম, মানে আমাদের জনপিছু বেড়ানোর বাজেটের থেকে কিছু কম। পরিস্থিতি দেখে বাবার কৃত্রিম হাঁটূ দুখানি ঠোকাঠুকিতে খুলে যাবার জোগাড়। নাহ! আর থাকা যাবেই না। কয়েকটা বুক মার্কার কিনে সে যাত্রায় সামাল দেওয়া হল। এবার বাকি গ্রাম পরিক্রমা করার পালা।

প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালেই শিল্পের ছোঁয়া, আর কি অপূর্ব সব কারুকার্য, কোনটা ফেলি কোনটা দেখি। ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়লাম আরেকটা বাড়িতে।এটা শিল্পী বিপিন দাসের বাড়ি। দেখি সুরুচি সংঘের কার্ড ঝোলানো । কি হল ব্যাপারটা? আসলে এই শিল্পী সুরুচি সংঘের দুর্গা মন্ডপের কাজ করেছেন, তা ছাড়াও কলকাতার নামী দামী পূজোর সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত । তাই বলি, এতো নতুনত্ব ফি বছর পায় কোথায় কলকাতার পূজা কমিটিগুলো?


শিল্পী বিপিন দাসের বাড়ি


দেখাশুনো শেষ, এবার ফেরবার পালা। হঠাৎ একজন হির হির করে টানতে টানতে নিয়ে চলল তার কুঠিরের দিকে। নারকেল ছোবড়ার কাজ না দেখিয়ে সে ছাড়বে না। আমার ক্যামেরা দেখে তার মনে হয়েছে সংবাদমাধ্যমের লোক, তাই বিজ্ঞাপনের সুযোগ সে কিছুতেই ছাড়তে নারাজ। তা ঢুকলাম তার ঘরে। উরিব্বাস কত সুন্দর সুন্দর সব পশুপাখির অবয়ব, শিল্পের ছোঁয়ায় যেন জীবন্ত হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে।



কিনতেই হবে তার কোন মানে নেই, দেখাশোনা ফ্রি- তাই ক্যামেরাটা বের করলাম। এপার্চার অগ্রাধিকার মোড সেট করে আই এস ও টা বাড়িয়ে যেই না মুখোশগুলোর দিকে তাক করেচি...



যাহ!! সব আলো বন্ধ, বিদুৎ বিভ্রাট। খোঁজ নিয়ে জানলাম- আকছার হয়। যার ফলে রাত্রিরে কাজ করা এদের পক্ষে বেদনাদায়ক। সেকি? ওরা যে বলছিল “আচ্ছে দিন এসে গেছে”। মানে আসার সময় মাইক হাঁকিয়ে এরকমই তো শুনলাম। যাইহোক অগত্যা ফ্ল্যাশের আলোতেই একটা দুটো ছবি তুলে এবার নিরালায় ফেরার পালা।



ঝিনুকের ইচ্ছায় আজকের নৈশভোজ চিলি চিকেন ফ্রায়েড রাইস। সকালে অবশ্য সুনীলের চাইনিজ রান্নার দক্ষতা নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠেছিল কিন্তু অটোটা বাড়ির সামনে এসে থামতেই মাংসের গন্ধে সব সন্দেহের অবসান ঘটল।


চলবে...


আগের পর্বের ঠিকানা

126 views

Comments


1.jpg
About Me

Ordinary Banker who loves to click while traveling, just to preserve golden memories of the past.

Read More

Join My Mailing List
  • White Facebook Icon
Meet me on social platform
bottom of page